“বাঙালিরা সংকর জাতি” ব্যাখ্যা কর।

“বাঙালিরা সংকর জাতি” ব্যাখ্যা কর।

অথবা, বাঙালি কে কেন মিশ্র জাতি বলা হয়?

অথবা, বাঙালি সংকর কর নরগোষ্ঠী কেন?

 

উত্তর: বাঙালি কোন একক নৃগোষ্ঠী থেকে আসেনি। বাঙ্গালীদের বাহ্যিক দৈহিক আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনায় কোন বিশুদ্ধ নরগোষ্ঠী অস্তিত্ব দেখা যায় না। প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ে বাঙালি জাতির সৃষ্টি। সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা বাঙালি একটি মিশ্র জাতি। তবে কোন কোন জাতির সমন্বয়ে বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:

 

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বা সীমানা/Geographical position and peripheri of Bangladesh

বাংলায় আগত জনগোষ্ঠীকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।  ক. প্রাক আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠী এবং খ. আর্য নরগোষ্ঠী

 

ক. আর্য নরগোষ্ঠী: আর্যরা এদেশে বহিরাগত জনগোষ্ঠী। তারা বাংলায় আগমন করে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের আগে। উত্তর ভারতে গিরিপথ দিয়ে প্রবেশ করে আর্যরা ক্রমে সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এদেশে আর্যরা বৌদিক সভ্যতার জন্ম দেয়। লম্বা মাথা, সরু ও মাঝারি নাক, গায়ের রং ফর্সা, পুরুষদের দাড়ি গোফের প্রাধান্য এবং বলিষ্ঠ গড়ন আর্যদের প্রধান দৈহিক বৈশিষ্ট্য। আগত অঞ্চলের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যরা দুটি নরগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল:

 

১. আলপাইন জনগোষ্ঠী:  নৃতত্ত্ববিদদের মতে খ্রিস্ট জন্মের বহু আগ থেকেই পামির মালভূমি হতে একটি জনগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশে এসে বসবাস শুরু করে। নৃতত্ত্ববিদগণ এদের নাম দেন আলপাইন নরগোষ্ঠী। তবে এদেশের আলপাইন আর্যভাষি গোষ্ঠী ছিল ইন্দো- ইরানি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বাঙালি, মারাঠি, গুজরাটি প্রভৃতি জাতির পূর্বপুরুষদের অনেকেই আলপাইন নর গোষ্ঠীর।

 

২. নর্ডিক জনগোষ্ঠী: বাঙালি জাতি গঠনে নর্ডিক নরগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ দেশে নর্ডিকরা আগমন করে উত্তর এশিয়ার তৃণভূমি অঞ্চল থেকে।

 

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর, অধ্যায় ৫

 

খ. অনার্য জনগোষ্ঠী: আর্যদের আগমনের পূর্ব থেকে এ দেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী অনার্য নামে পরিচিত। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এরা বাংলা অঞ্চলে বসবাস করে এসেছে। এরাই হচ্ছে বাঙ্গালীদের আদি জনগোষ্ঠী।

অনার্য জনগোষ্ঠী আবার চারটি প্রধান শাখায় বিভক্ত:

১. অস্ট্রিক বা অস্ট্রালয়েড: ঐতিহাসিকদের মতে অস্ট্রিকরাই এদেশের প্রাচীনতম বাসিন্দা। বর্তমানে বাঙ্গালীদের মধ্যে এ নৃগোষ্ঠীর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

২. নেগ্রিটো: বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলের জনগণের মধ্যে এই নরগোষ্ঠীর প্রভাব বেশি দেখা যায়।

৩. দ্রাবিড়: এরা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে এদেশে আগমন করে। এ জনগোষ্ঠীর সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা। দক্ষিণ ভারতে এ গোষ্ঠীর লোকদের প্রাধান্য দেখা যায়।

৪. মঙ্গোলয়েড: পূর্ব এশিয়ায় মঙ্গোলীয় নর গোষ্ঠী বসবাস করে থাকে। এ জনগোষ্ঠী দক্ষিণ ও পশ্চিম চীন থেকে এদেশে আগমন করে। বাংলাদেশের লেপচা, ভুটিয়া, চাকমা, গারো, খাসিয়া, ত্রিপুরা, মারমা ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা এই নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

 

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ও উত্তর, অধ্যায় ১০/History of the Emergence of Independent Bangladesh, Super Brief Questions and Answers, Chapter 10

 

এছাড়া পরবর্তীকালে ধর্ম প্রচার ও ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা দেশ জয়ের সুবাদে এদেশে আরও বিভিন্ন রক্ত ধারার লোকদের আগমন ঘটে। মধ্যে এশিয়া, পারস্য, তুরস্ক, ইউরোপ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে আসা তুর্কি, পাঠান, মোগল, ইরানি,  ইংরেজ, পর্তুগিজসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এদেশে বসবাস করার সুবাদে বাঙ্গালী রক্তের সাথে তাদের সংমিশ্রণ ঘটেছে।

 

 

পরিশেষে বলা যায়, প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালি নরগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং জাতি হিসেবে বাঙালি যে একটি সংকর জাতি তাতে কোন সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *